অন্তর্বর্তী সরকারের গত ১৫ মাসে দেশের গণমাধ্যমে চলছে দখলদারিত্ব, চাকরিচ্যুতি আর হত্যা মামলায় আসামী করার হিড়িক। সরকারের অদৃশ্য ইশারায় মিডিয়াগুলোতে চলছে নিয়ন্ত্রন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের ইশারায় বাইরে কোন গনমাধ্যম সরকারের সমালোচনা করার সাধ্য নেই। জুলাই আন্দোলন পরবর্তী সময়ে গড়া উঠা এনসিপি কয়েক নেতার বিরুদ্ধে কয়েকটি গণমাধ্যম দখলের অভিযোড় উঠেছে। দেশের সব গণমাধ্যমের শীর্ষ পদ দখলে নিয়েছে বিএনপি জামায়াতের অনুসারীরা। এই সময়ে চাকরি হারিয়েছেন অন্তত সহস্রাধিক সাংবাদিক। হত্যা মামলার আসামী হয়েছেন ৩ শতাধিক সাংবাদিক। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও দেশের সাংবাদিকদের নির্যাতনের চিত্র উঠে এসেছে।

একাধিক সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের গত ১৫ মাসে ১ হাজার সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েচে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিশ্বাসী ৩০০ সাংবাদিকের নামে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা হত্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। ঘটেছে একাধিক সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। অর্ধশত সাংবাদিককে কারাগার রয়েছে। বেশ কয়েক জন জামিন মেললেও বাকিরা এখনো কারাগারে। অন্তত ২১৯ জন সংবাদকর্মী পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে হামলার শিকার হয়েছেন।
মব সৃষ্টি করে পত্রিকা-টিভি, অনলাইনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম দখলের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে- জনকণ্ঠ, মাই টিভি, ডিবিসি, সময় টেলিভিশন, একুশে টিভি। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জয়নাল আবেদিন শিশিরের নেতৃত্বে দখল করা হয়েছে। কথিত মব ও গ্রেফতার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে অন্তত ২ সহস্রাধিক সাংবাদিক। প্রাণভয়ে দেশ ছেড়েছেন অন্তত শতাধিক সাংবাদিক।
জুলাই আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরপরই জাতীয় প্রেসক্লাব দখলে নেয় বিএনপি-জামায়াতপন্থী সাংবাদিকরা। কোনো ধরণের নির্বাচন ছাড়াই অগণতান্ত্রিকভাবে প্রেসক্লাব পরিচালনা করা হচ্ছে। জাতীয় প্রেস ক্লাব কমিটির পদ অবৈধভাবে দখল করে অগঠনতান্ত্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ১০০ সাংবাদিকের সদস্যপদ স্থগিত/বহিষ্কার করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধেও চেতনাধারী ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের অফিসের টাকাসহ মালামাল লুট করে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে তালা দিয়ে রাখা হয়েছে। ২ শতাধিক পেশাদার সাংবাদিকের এ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছে। অর্ধশত সাংবাদিকের ব্যাংক হিসাব তলব ও জব্ধ করা হয়েছে।
গত এপ্রিলে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে প্রশ্ন করায় তিন সাংবাদিকের চাকরি হারানোর ঘটনাও দেখেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে এটিএন বাংলার রিপোর্টার ফজলে রাব্বী, দীপ্ত টিভির রিপোর্টার মিজানুর রহমান (রহমান মিজান) ও চ্যানেল আই-এর রিপোর্টার রফিকুল বাসারের প্রশ্ন এবং পরবর্তী ঘটনাবলী ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।
এছাড়া সময় টেলিভিশনের কয়েক সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতির পেছনে এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ হাত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মাইটিভি’র চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন সাথী ও তার ছেলে ইউটিবার তৌহিদ আফ্রিদি এখনো কারাগারে আছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময় মিডিয়ার অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে সাংবাদিক মাসুদ কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, “আমি খুব বেশি পরিবর্তন দেখি না। আগে যারা মিডিয়ার দায়িত্বে ছিলেন, তারা শেখ হাসিনার সুবিধাভোগী হয়ে নিজেরাই তার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেন। এর জন্য কাউকে কিছু বলতে হতো না। আর এখন মিডিয়ার শীর্ষ পদে বিএনপি ও জামায়াতের লোক বসানো হয়েছে। ফলে, তারা এখন বিএনপি ও জামায়াতের স্বার্থ দেখছে। আগেও সাংবাদিকরা স্বাধীন ছিল না, এখনও নেই।”

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্য মতে, শুধু মাত্র চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট- এই আট মাসে ২৭৪ জন সাংবাদিক হামলা, নির্যাতন ও মামলার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৭৩ জন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে নির্যাতন ও হামলার শিকার হন। সাংবাদিক নির্যাতনে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ছাড়াও প্রশাসন ও পুলিশের লোবজনও আছেন। ওই সময়ে হত্যার হুমকি পেয়েছেন ১১ জন সাংবাদিক। আর ৪৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিবেদনে টিআইবি বলছে, সাংবাদিক, লেখক ও মানবাধিকারকর্মীদের ওপর হামলা ও হয়রানির ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ৪৯৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন, এর মধ্যে ২৬৬ জনকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান সংক্রান্ত হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। তিনজন সাংবাদিক দায়িত্ব পালনকালে হামলায় নিহত হয়েছেন (আগস্ট ২০২৪ থেকে জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত)।









