
গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশের নিষ্ক্রিয়তাকে সক্রিয় করতে কাজ করছেন ঊর্ধ্বতনরা। বিগত এক বছরে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা অন্যতম এ বাহিনীর কার্যক্রমে সক্রিয়তা ফিরেছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। যদিও বিভাগীয় মামলার ভয়ে আতঙ্কে রয়েছেন অনেক সদস্যই। এরই মধ্যে কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের হঠাৎ হঠাৎ বের করা ঝটিকা মিছিল সামলাতে বেগ পেতে হচ্ছে। ঝটিকা মিছিল ঠেকাতে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা রয়েছেন প্রচণ্ড চাপে। যে কোনো মূল্যে এমন মিছিল ঠেকাতে সব মহানগর ও জেলা পুলিশের ওপর কঠোর নির্দেশনা রয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরের। যে নির্দেশনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট ইউনিটপ্রধান অধীন থানা ও গোয়েন্দা পুলিশকে চাপে রাখা হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটের বাইরে নন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) সদস্যরাও।
গত বছরের ৫ আগস্টের পর চট্টগ্রাম মহানগরীতে কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ এবং এর নিষিদ্ধ ঘোষিত সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ বা অন্য কোনো সহযোগী সংগঠনের মিছিল-সভা-সমাবেশের মতো কর্মসূচির দেখা মেলেনি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পরপরই আত্মগোপনে চলে যান দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। ফলে ভেঙে পড়ে দলীয় নেতৃত্বের কাঠামো। কর্মীদের রেখে নেতারা আত্মগোপনে যাওয়ায় তৃণমূলে কর্মীদের মধ্যে রয়েছে ক্ষোভ। দিন বদলের পালার অপেক্ষায় থাকা আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের গত এক বছর তেমন কোনো তৎপরতা ছিল না রাজনীতির মাঠে। কিন্তু সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার আগে আগে ঝটিকা মিছিলের মাধ্যমে অস্তিত্ব জানান দিতে শুরু করেছেন এসব সংগঠনের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন নগর ও শহরে কয়েক মিনিটের ‘ঝটিকা’ মিছিল বের করতে দেখা যাচ্ছে তাদের। যার জন্য জবাবদিহি করতে হচ্ছে ‘ঝটিকা’ মিছিল বের হওয়া থানা এলাকার পুলিশ সদস্যদের। বিশেষ করে মিছিলের সংখ্যা এবং মিছিলের বহরে নেতাকর্মীদের সংখ্যা গেছে বেড়ে, যা ভাবিয়ে তুলেছে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। এমন প্রেক্ষাপটে ঝটিকা মিছিল ঠেকানো এখন থানা পুলিশের অগ্রাধিকারের তালিকায় উঠে এসেছে।
ঢাকা মহানগরীসহ দেশের অন্যান্য জায়গায় নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ‘ঝটিকা’ মিছিলে তেমন সক্রিয় হতে পারেননি। তবে চট্টগ্রাম মহানগরীতে এর চিত্র ভিন্ন। গত বছরের ৫ আগস্টের পর চট্টগ্রাম মহানগরীর ডবলমুরিং থানা এলাকায় ৬ বার ‘ঝটিকা’ মিছিল করেছেন ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের সমর্থকরা। এ ছাড়া নগরীর খুলশী, চান্দগাঁও, বন্দর, চকবাজার ও কোতোয়ালি থানা এলাকায় ঝটিকা মিছিল হয়েছে। এমনকি ঝটিকা মিছিল ঠেকাতে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা। আবার ঝটিকা মিছিল ‘সংগঠিত’ হওয়ার কারণে থানার ওসি সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন।
সিএমপির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘৫ আগস্টের ট্রমা এখনো পুলিশ সদস্যদের তাড়া করে। পুলিশের শূন্যতায় নগরীতে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ইত্যাদি অপরাধের মাত্রাও বেড়ে গিয়েছিল। সে সময় অনেক এলাকায় মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে সাহায্য চেয়েছিল নগরবাসী। নগরবাসীর জানমালের নিরাপত্তা দিতে পুলিশ সদস্যরা ট্রমা নিয়েও নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগদান করেছেন। তবে থানা এলাকায় তাদের জন্য নতুন আতঙ্ক এখন নিষিদ্ধ সংগঠনের ঝটিকা মিছিল। এ বিষয়টি কমিশনার মহোদয়ের পক্ষ থেকে শক্ত হাতে দমন ও গ্রেপ্তারের নির্দেশনা রয়েছে।’
এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘যে থানা এলাকায় মিছিল সংগঠিত হবে, সে থানার সব সদস্যের ঘুম হারাম। মিছিলের কারণে যে কেউ প্রত্যাহার হতে পারেন।’
গতকাল রোববার ভোরে নগরের ষোলোশহর এলাকায় ঝটিকা মিছিল করেছে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ। চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের ব্যানারে এই মিছিল বের হয়। যার একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এ মিছিলে অংশ নেওয়ার অভিযোগে আনোয়ারুল হক ওরফে ইশান, রাজন দাশ ও সৈকত চন্দ্র ভৌমিক নামে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনজনেরই বাসা নগরের পাঁচলাইশ এলাকায়।
পাঁচলাইশ থানার ওসি মোহাম্মদ সোলাইমান বলেন, ‘নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের ১৫ থেকে ২০ জন কর্মী ভোরে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সামনে ঝটিকা মিছিল বের করেন। মিছিলে অংশ নেওয়া তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদেরও গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।’
এর আগে গত শুক্রবার জুমার নামাজ চলাকালীন বাঁশখালীতে ঝটিকা মিছিল করে উপজেলা ছাত্রলীগ। তাৎক্ষণিক মিছিলের একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ থেকে ত্রিশজন যুবকের অংশগ্রহণে এই মিছিল বের হয়।
এ প্রসঙ্গে বাঁশখালী থানার ওসি সাইফুল আলম বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওর লিঙ্ক আমরা পেয়ে তা যাচাই-বাছাই করছি। মিছিলটি বাঁশখালীর কোন এলাকায় সংগঠিত হয়েছে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। জুমার নামাজ চলাকালীন মিছিলটি বের হতে পারে বলে ধারণা করছি।’
ঝটিকা মিছিল আতঙ্কের বিষয়ে জানতে চাইলে সিএমপির সহকারী কমিশনার (গণসংযোগ) আমিনুর রশিদ বলেন, ‘সম্প্রতি নিষিদ্ধ সংগঠনের ঝটিকা মিছিল সংগঠিত হচ্ছে। দু-একদিনের মধ্যে একটু বেশি হচ্ছে। আমাদের থানা পুলিশের পাশাপাশি ডিবি পুলিশের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। অভিযান অব্যাহত রয়েছে, গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে।’
নিষিদ্ধ সংগঠনের পলাতক নেতৃবৃন্দ ফিরে আসতে পারে—এমন কোনো তথ্য পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে নগর পুলিশের এই মুখপাত্র বলেন, ‘তারা তো আত্মগোপনে রয়েছেন। ফিরে আসার কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত নেই। এ ছাড়া সুযোগও নেই।’
দেশপক্ষ/ এমএইচ









