ঢাকা, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৫৬ পূর্বাহ্ন

ঢাকা জুড়ে আতঙ্ক, ফাঁকা সড়ক

আওয়ামী লীগের লকডাউনকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারাদেশে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গত কয়েক দিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ককটেল নিক্ষেপ করা হয়েছে স্কুলসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে। এসব ঘটনায় চাকরিজীবী, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, ব্যবসায়ীসহ সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে বিরাজ করছে আতঙ্ক। গতকাল ১২ নভেম্বর কার্যত অচল ছিলো ঢাকা। রাস্তায় যানবাহন তেমন ছিলো না। কঠোর অবস্থানে রয়েছে আইন-শৃঙখলা বাহিনীর। এর মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরন ও আগুনে দেয়া ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার দায় অস্বীকার করেছে আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারা বলছে- আওয়ামী লীগের লকডাউনে সাধারণ মানুষের ব্যাপক সাড়া দেখে অন্তবর্তী সরকার ও জামায়াত েএসব ঘটনা ঘটিয়ে আওয়ামী লীগের উপর দায় চাপাচ্ছে।

single-ad-main-1

লকডাউন আতঙ্কে রাজধানীর অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল কলেজ বন্ধ রয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও তেমন খুলে নি। বাস চলাচল করছে না বললেই চলে। পার্বত্য এলাকায় রাস্তায় গাছ ফেলে যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। বন্দর নগরী চট্টগ্রামও একই অবস্থা চলছে।

পুলিশ সূত্র জানায়, বুধবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে গ্রামীণ ব্যাংকে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। কে বা কারা এ অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়েছে সেটা জানা যায়নি। গাজীপুরে আলাদা তিন স্থানে তিনটি বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) রাত থেকে বুধবার ভোর পর্যন্ত জেলার শ্রীপুর, মহানগরীর ভোগড়া বাইপাস ও চক্রবর্তী এলাকায় এসব অগ্নিসংযোগ করা হয়। তিনটি ঘটনায় বাসগুলো পুড়ে গেলেও কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। তবে মঙ্গলবার ময়মনসিংহে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে আগুন দিলে চালক নিহত হন। গত দু-তিনদিনে ঢাকায় বেশ কয়েকটি বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। রাজনৈতিক কার্যালয় লক্ষ্য করে ছোড়া হয়েছে ককটেল। সারাদেশে গ্রামীন ব্যাংকের একাধিক অফিসে আগুন দেয়া ঘটনা ঘটেছে।

এসব ঘটনায় দোষীদের দ্রুত শনাক্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা। তারা সতর্ক করে বলেন, সহিংসতা অব্যাহত থাকলে দেশে অস্থিতিশীলতা বাড়বে, ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হবে এবং সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

single-ad-main-2

রাজনৈতিক সহিংসতা এখন নগরবাসীর জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এটি আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আমরা চাই আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক এবং দ্রুত এ সংকটের সমাধান আসুক।- স্কুলশিক্ষার্থীর অভিভাবক ফারুক সোবহান

সহিংস কর্মকাণ্ড বন্ধে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি, নাগরিকদের নিরাপদ চলাচল ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

বুধবার (১২ নভেম্বর) ঢাকার বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাটও তুলনামূলক ফাঁকা দেখা গেছে। রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়িও কম।

চলমান সহিংস পরিস্থিতিতে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যেও গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। অনেকেই জানিয়েছেন, নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় তারা সন্তানদের আপাতত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না পাঠানোর কথা ভাবছেন। তারা সরকার ও সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন—সহিংসতা বন্ধ করে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।

রাজধানীর সেন্ট জোসেফ স্কুল অ্যান্ড কলেজে ককটেল, মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে প্রিপারেটরি স্কুলে দুটি পেট্রোলবোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় আতঙ্কে স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং অভিভাবকরা। অনেক স্কুল এরই মধ্যে ১৩ নভেম্বর ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় স্থগিত করেছে ক্লাস-পরীক্ষা। অনলাইনে কার্যক্রম চালাচ্ছে কেউ কেউ।

মিরপুরের বাসিন্দা ও এক স্কুলশিক্ষার্থীর অভিভাবক ফারুক সোবহান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি অনুকূল নয়, তাই আমি আগামীকাল আমার ছেলেকে স্কুলে পাঠাবো না। রাজনৈতিক সহিংসতা এখন নগরবাসীর জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এটি আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আমরা চাই আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক এবং দ্রুত এ সংকটের সমাধান আসুক।’

ব্যবসায়ীরা বলছেন, যদি এ অস্থিরতা অবিলম্বে নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তাহলে এটি দেশের জন্য একটি খারাপ সংকেত হিসেবে দেখা দিতে পারে।

বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘অবশ্যই আমরা শঙ্কিত। তবে আমরা মনে করি না এটি বড় আকারের কোনো সমস্যা হবে। আমরা আশাবাদী যে সরকার এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবে। আমরা কিছুটা কাজও করছি। আমি আশা করি সব রাজনৈতিক দল বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি রাখবে, যেন কেউ এ ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে। আমরা সব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা কামনা করি। ব্যবসায়ী হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির জন্য অন্তত শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় থাকে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন ব্যবসায়ী নেতা বলেন ‘ব্যবসায়ী হিসেবে আমরা দেশের মানুষকে বিপদে ফেলতে এমন কোনো কর্মকাণ্ড কখনোই সমর্থন করি না। অতীতে আমরা সমর্থন করিনি, এখনো করি না এবং ভবিষ্যতেও করবো না। এটি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।’

সাম্প্রতিক অগ্নিসংযোগ ও গণপরিবহনে আগুন লাগার ঘটনায় অফিসগামী ও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে হঠাৎ আক্রমণের ভয় বিরাজ করছে।

কিছুদিন ধরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দল ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্ন অপপ্রচারের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে, বিশেষ করে ঢাকা শহরের।- ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী

রাজীব খন্দকার নামে এক বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, ‘আমাকে অফিসে যেতে হবে, কিন্তু ভয় হচ্ছে যে দুষ্কৃতকারীরা তাদের সহিংস কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে আহত করতে পারে। যাত্রাপথটি এখন নিরাপদ মনে হচ্ছে না।’

ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গত ২৩ অক্টোবর জানায়, ২০২৪ সালের আগস্টে সংঘটিত ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায়’ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায় ঘোষণার তারিখ ১৩ নভেম্বর নির্ধারণ করা হবে। এ ঘোষণার পর থেকেই ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ও বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, ‘গত কয়েকদিনে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, হেলমেট ও মাস্ক পরে ভোরবেলা অথবা দিনের ব্যস্ততম সময়ে টার্গেট করা স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ করে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি রাজনৈতিক দল। অনেক সময় ককটেল বিস্ফোরণে অপ্রাপ্তবয়স্কদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে। দু-একটি মোটরসাইকেল থেকে ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে, তবে এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এসব ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেফতারের কাজ চলছে।’

তিনি বলেন, ‘কিছুদিন ধরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দল ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্ন অপপ্রচারের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে, বিশেষ করে ঢাকা শহরের। গত কয়েকদিনে ঢাকা শহরে ককটেলসদৃশ বস্তু নিক্ষেপ এবং বিভিন্ন যানবাহনে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক ছড়ানোসহ আইনশৃঙ্খলা বিনষ্ট করার অপচেষ্টা রয়েছে।’

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম ও মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী আরাফাত এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। মি. আরাফাত বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সুযোগ নিয়ে সরকারের প্রশ্রয় পাওয়া সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো এ ধরনের নাশকতা করতে পারে। আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করবে।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, শেখ হাসিনার মামলার রায়কে ঘিরে বিচ্ছিন্ন সহিংসতায় মানুষের আতঙ্কিত হওয়া স্বাভাবিক। ‘রায় হলে আওয়ামী লীগ ব্যাকফুটে যাবে। তাই তারা এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। কিন্তু আতঙ্ক তৈরি করতে চাইলে সেটি ঠেকানো কঠিন। ২০১৩-১৪ সালেও এমন ঘটেছে। ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক মীমাংসার পথে দুই পক্ষের পুনর্মিলন না হলে এ সমস্যা চলবে, যা পুলিশ দিয়ে সমাধান করা সম্ভব নয়

 

নিউজটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

ট্যাগঃ